"পৃথিবীর ইতিহাস"

পৃথিবীর ইতিহাস লিখিত ইতিহাস মাত্র ৭০০০ বছরের। এই ইতিহাসের ব্যপ্তি চিন্তা করলে মহাবিশ্বের বাকি পুরো ইতিহাসকে এখনও তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু এ অবস্থা হয়ত বেশিদিন থাকবে না। মহাজাগতিক ইতিহাস রচনার দিকে আমরা অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছি। আর পৃথিবীর ইতিহাস তো অনেকটাই লেখা হয়ে গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসকে বলা যায় ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস। এই লেখার উদ্দেশ্য ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরা, বছর অনুযায়ী। ইতিহাসের পাঠ শুরু হবে ৪.৬ বিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে, যখন পৃথিবী গঠিত হয়েছিল। সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে হোমো স্যাপিয়েন্সের বিবর্তনের ইতিহাস যে কত নগণ্য মনে হয় সেটা হয়ত অনুভব করা যাবে। কিন্তু এই ভেবে আমরা স্বস্তি পাব যে ইতিহাসের এই নগণ্য-নগণ্য খেলা আবিষ্কারের যোগ্যতা আমাদের জানামতে একমাত্র আমাদেরই আছে। ইতিহাস শেষ হবে এই একবিংশ শতকে এসে। পুরোটা লেখা হবে এনকার্ট বিশ্বকোষে সংযুক্ত টাইমলাইন অনুসরণ করে। আসলে এটাকে এনকার্টা টাইমলাইনের অনুবাদই বলা যায়।

৪.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বে সূর্যের উৎপত্তি হয়েছিল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সংকোচনশীল একটি গ্যাসপিণ্ড হিসেবে। সংকুচিত হতে থাকায় এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। একসময় কেন্দ্রে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয় শুরু হয় অর্থাৎ হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম উৎপন্ন হতে শুরু করে। এভাবেই বিপুল শক্তির সৃষ্টি হয়। এই শক্তি মহাকর্ষ বলের বিপরীতে কাজ করে। আজ থেকে ৪.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বে অন্তর্মুখী মহাকর্ষ বল ও বহির্মুখী নিউক্লীয় বলের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপিত হয় এবং সূর্য বর্তমান আকার লাভ করে। এত বছর ধরে সূর্য ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় আছে।

মোটামুটি একই সময়ে সৌর নীহারিকার অনেক ধূলিবালি ও ক্ষুদ্র-গ্রহাণু (planetesimal) মহকার্ষের প্রভাবে কিছু স্থানে জড়ো হতে শুরু করে। এভাবেই পৃথিবী তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই বিবৃদ্ধির (accretion) মাধ্যমে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলেছিল।

৪.৫৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে প্রথমে পৃথিবীর একটি বায়ুমণ্ডল তৈরী হয়েছিল। কিন্তু সূর্য থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রচণ্ড বেগে বেরিয়ে আসা ধূলি প্রবাহের প্রভাবে এই বায়ুমণ্ডল মহাশূন্য মিলিয়ে যায়। এই ধূলিঝড় ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে এবং এক সময় আয়নিত কণার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে পরিণত হয় যাকে আমরা বলি সৌর বায়ু (Solar wind)।

এ সময়ই পৃথিবীর আদিম বায়ুমণ্ডল গঠিত হয় আগ্নয়েগিরি থেকে উদ্‌গত গ্যাস দিয়ে। এসব গ্যাসের কিছু অংশ ঘনীভূত হয়ে আদিম মহাসাগরগুলো তৈরী করে। এসব সাগরে পরবর্তীতে জীবনের বিকাশ ঘটে এবং এই জলীয় জীবেরাই অক্সিজেন উৎপাদন শুরু করে।

৪.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে বিবৃদ্ধির মাধ্যমে পৃথিবী গঠিত হওয়ার আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন বছর পর পৃথিবীর কেন্দ্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভেতরের ক্রিয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় লোহার গুড়াগুলো গলে ডুবে যায়। এরা কেন্দ্রে নিকেল এবং অন্যান্য পদার্থের সাথে মিলে কেন্দ্র তৈরী করে। কেন্দ্রে তাপমাত্রা এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও অত্যধিক চাপের কারণে সে অংশটা কঠিন হয়ে যায়।

সম্ভবত কেন্দ্র তৈরী হওয়ার পর নির্গত বিপুল পরিমাণ মহাকর্ষীয় শক্তির প্রভাবে পৃথিবীর বহির্ভাগ গলে যায়। এর ফলে পুরো বিশ্ব জুড়ে এক বিশাল ম্যাগমা সাগর তৈরী হয়। ম্যাগমা বলতে গলিত শিলাকেই বোঝায়। ধারণা করা হয় এই ম্যাগমা সাগর কেলাসিত হয়েই পৃথিবীর ম্যান্টল তথা আদিম ভূত্বক তৈরী করেছিল। এ সময়ই চাঁদ তৈরী হয়। সম্ভবত মঙ্গল গ্রহের চেয়েও তিন গুন বড় কোন মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীকে আঘাত করেছিল। এই আঘাতে পৃথিবীর একটা বিশাল অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাশূন্যে চলে যায়। এই অংশ বা অংশগুলোই পৃথিবীর মহাকর্ষের প্রভাবে এর উপগ্রহ তথা চাঁদে পরিণত হয়। মহাশূন্যে ছুটে যাওয়া পার্থিব বস্তুগুলোর বিবৃদ্ধির মাধ্যমেই চাঁদ গঠিত হয়েছিল।

৪.২ বিলিয়ন বছর পূর্বে টেক্টোনিক প্লেটগুলোর স্থানচ্যুতির কারণে ভূত্বকের শিলাগুলো রিসাইক্‌ল করে ম্যান্টলে চলে যায়। এভাবেই আদিম মহাদেশগুলো গঠিত হয়। বর্তমানে অবশ্য আরও সূক্ষ্ণ পরীক্ষণের মাধ্যমে জানা গেছে এই ঘটনা ৩.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটেছিল।

৩.৮৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে আর্কিয়ান ইয়ন শুরু হওয়ার সামান্য আগের কাহিনী। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীর সাথে ক্ষুদ্র-গ্রহাণুগুলোর সংঘর্ষের পরিমাণ অনেক কমে আসে। অর্থাৎ এই গ্রহাণু আকৃতির বস্তুগুলো পৃথিবীর দিকে অনেক কম আসতে থাকে। এর ফলে নতুন তৈরী হওয়া মহেদেশগুলো স্থিতিশীল হওয়ার সুযোগ পায়। ৩.৮ – ২.৫ বিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত এই যুগটাকে বলে আর্কিয়ান ইয়ন। তার মানে ৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে আর্কিয়ান ইয়ন শুরু হয়েছিল। এই যুগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো হচ্ছে:

৩.৫ – ২.৭ বিলিয়ন বছর পূর্বেকার মধ্যে সবগুলো মহাদেশেই ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ এক ধরণের লাভা উদ্‌গত হতে থাকে যাকে কোমাটিইট (komatiite) বলা হয়। এসব উদ্‌গীরণের তাপমাত্রা ছিল আনুমানিক ১৬০০° সেলসিয়াস। ৩.২ বিলিয়ন বছর পূর্বে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন হীরাগুলো এ সময় গঠিত হয়। সে সময় পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা কার্বনগুলো উচ্চ চাপ এবং স্বল্প তাপমাত্রা ঘনীভূত হয়ে হীরায় পরিণত হয়েছিল। আদিম জীবদের দেহাবশেষ থেকেই সম্ভবত এসব কার্বন পাওয়া গিয়েছিল।

২.৭ বিলিয়ন বছর পূর্বে আধুনিক মন্টানার বেয়ারটুথ রেঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলের একটি স্থানে বিপুল পরিমাণ ম্যাগমা আর্কিয়ান শিলাগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল। এই অনুপ্রবেশকে বলায় হয় স্টিলওয়াটার কমপ্লেক্স (Stillwater Complex)। এখানেই উত্তর আমেরিকার সর্ববৃহৎ প্লাটিনাম খনি পাওয়া গেছে। ২.৫৯ বিলিয়ন বছর পূর্বে আধুনিক জিম্বাবুয়ের মাঝামাঝি একটি স্থানে গলিত শিলাগুলো কঠিন শিলাগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। এর ফলে মৌলিক শিলাগুলো ক্ষয়ে যেতে থাকে এবং যথারীতি অক্ষত অনুপ্রবেশগুলো মিলে সারি সারি নিচু পাহাড় তৈরী করে। এই পর্বতমালাকেই বর্তমানে গ্রেট ডাইক (Great Dyke) বলা হয়।