"জেনারেল থিউরীঃ-"

অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান এই গল্পের শুরু হলো আগুনের রঙ ফলানো থেকে৷ বুনসেন আর কির্চফের কাজকর্মের গল্প। দূরের আলোক-উত্সের আলো যেতে দেয়া হলো প্রিজমের (বা গ্রেটিংএর) মধ্য দিয়ে৷ আলোর স্পেকট্রাম পাওয়া গেলো, মানে নানারঙ৷ বাঁদিকে বেগুনী থেকে ডাইনে লাল পর্যন্ত৷ বেগুনী নীল আশমানী সবুজ হলুদ কমলা লাল৷ বাঁদিক মানে কম ওয়েভলেংথ আর ডানদিক বেশী ওয়েভলেংথ৷ আজকালের হ্যান্ড হেল্ড স্পেকট্রোস্কোপে দেখেছি একেবারে স্কেলকাটা থাকে, ন্যানোমিটার ইউনিটে৷ কঠিন উত্স হলে বা ঘন গ্যাস হলে পাওয়া যায় কন্টিনুয়াস, রঙের চওড়া চওড়া ব্যন্ডগুলো পাশাপাশি মিশেমিশে থাকে, রামধনুটি ঝলমলে,লাইনটাইন কিছু থাকে না৷

গ্যাসীয় মৌলকে খুব পাতলা করে অল্প চাপে টিউবে রেখে উপরে নীচে ইলেকট্রোড জুড়ে স্পার্ক মেরে জ্বালানো হলো৷ সেই আলোর স্পেক্ট্রাম ফলিয়ে তো লোকে তাজ্জব! সরু সরু লাইন দেখা যায়৷ বিশেষ বিশেষ ওয়েভ্লেংথে লাইন! লাল লাইন৷ বেগুনী লাইন!

    কী অদ্ভুত! মনে রাখতে হবে তখনো কিন্তু শক্তির কোয়ান্টাম চরিত্র সম্পর্কে লোকের কোনো ভালো ধারনা ছিলো না৷ শক্তি যদি অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, কন্টিনুয়াস হয়, তাইলে এমন লাইন হওয়ার কথাই নয়! পরে প্লাংক বোর আইনস্টাইন সবাই মিলে লড়ে টড়ে খাড়া করলেন শক্তির বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব৷ শক্তি বিকিরিত হয় কোয়ান্টামে৷ অ্যাটমের নানা নির্দিষ্ট এনার্জী স্টেট থাকে, একটা থেকে আরেকটায় যখন যায় তখন সেই পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে৷ কন্টিনুয়াস যায় না, সাডেন চেঞ্জ হয়৷ এটাকে ইলেকট্রনের কক্ষ থেকে কক্ষে ঝাঁপমারার ছবি দিয়ে বোঝা যায় ভালো যদিও ও ছবিতে লুপহোল আছে৷ (মানে ঝাঁপ দেয় কোথা দিয়ে? দুইকক্ষের মাঝে তো থাকতে পারেনা ইলেকট্রন! তাইলে এক কক্ষে অদৃশ্য হয়ে কি অন্য কক্ষে ভুস করে ওঠে?) তবে মোটের উপর বোঝা গেলো শক্তির এই কোয়ান্টা আইডিয়া দিয়ে লাইনগুলো ব্যখা করা যাবে৷

শুধু এই স্পেকট্রাল লাইন না, আরেকটা জিনিসও খুব বিপদে ফেলে দিয়েছিলো লোকেদের৷ সেটা হলো ফোটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট৷কোনো কোনো মৌলের পাতে আলো বা অন্য কোনো ইলেক্টোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পড়লে ফটাশ ফটাশ করে ইলেকট্রন ছিটকে ছিটকে বেরোয়৷ দেখা গেলো একেবারে ইন্সট্যান্টলি বেরোয়, একটুও টাইম ল্যাগ থাকে না৷কিন্তু ওয়েভলেংথ খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এক একটা নির্দিষ্ট ওয়েভলেংথের আলো পড়লেই শুধু ইলেকট্রন বেরোয়, নাহলে বেরোয় না,ঘন্টা ধরে আলো ফেল্লেও বেরোয় না৷ দেখেশুনে লোকে বিরক্ত৷শক্তি কন্টিনিউয়াস হলে এরকম মোটেই হোতো না৷

তো, আইনস্টাইন করলেন কি, প্লাংকের কোয়ান্টাম আইডিয়াটাকে নিয়ে ফটাফট এখানে লাগিয়ে দিলেন৷ ছোটোখাটো কতগুলো ইকোয়েশন E=h*frequency, h হলো প্লাংক ধ্রুবক, এই ধরনের সহজ সহজ সমীকরণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে আলো বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন নির্দিষ্ট মানে এলে এইরকম হতে পারবে৷ এই কাজের জন্য তিনি বেশ কবছর পরে নোবেল পেলেন৷

অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান(২) উল্টোদিক থেকে আবার আরেক গেরো বাঁধিয়ে বসলেন কয়েকজন এক্সপেরিমেন্টালিস্ট৷ তাঁরা ইলেকট্রনের এমন এক ডিফ্রাকশন প্যাটার্ণ পেলেন যে লোকে তাজ্জব! ইলেকট্রনকে এতকাল কণা বলেই বোঝা যাচ্ছিলো, অথচ কিনা শেষে তার এই চিত্র! ডিফ্রাকশন শুধু তরঙ্গের হতে পারে, কণার ক্ষেত্রে হয় না৷ কণা একই সময়ে একটিমাত্র বিন্দুতেই থাকতে পারে, তাই তার বিন্দুচিত্রই পাবার কথা, কিন্তু তরঙ্গ স্পেসে ছড়িয়ে থাকে, তার ডিফ্রাকশন পাওয়া যায়৷যেমন আলোর বা এক্সরের ডিফ্রাকশন হয়৷ কিন্তু ইলেকট্রনের পাওয়া গেলো, পরে অন্য কোয়ান্টাম পার্টিকলেরও৷ তখন লুই দ্য ব্রগলী এক হাইপোথিসিস দিলেন, বললেন সমস্ত ভরবেগসম্পন্ন পার্টিকলের মধ্যেই আছে তরঙ্গধর্মীতা, নেহাত বড়ো বড়ো পার্টিকলের ক্ষেত্রে এটা বুঝতে পারা যায় না,কারণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য খু-উ-উব কম৷ তিনি সমীকরনও দিলেন,ওয়েভলেংথ = প্লাংক ধ্রুবক/ মোমেন্টাম৷

আস্তে আস্তে নানা পরীক্ষায় ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেলো৷ বোঝা গেলো ক্ষুদ্র জগত্টা আমাদের দেখা জগতের মতন নয়, সেখানে কণা ও তরঙ্গ আলাদা করে সুসংজ্ঞিত করা যায় না৷ ডুয়ালিটি ধারনাটা তখনি এলো৷ সমস্ত ইলেক্টোম্যাগ্নেটিক ওয়েভ যেমন তরঙ্গ তেমনি কণাও৷ তেমনি প্রতিটি কোয়ান্টাম পার্টিকল একাধারে কণা ও তরঙ্গ৷ পরে এই ব্যাপারটা হাইজেনবার্গ আর শ্রোডিংগার আরো ভালো করে গণিতের ফ্রেমে বসান৷হাইজেনবার্গ আবিষ্কার করেন অনিশ্চয়তা তত্ব৷ কোনো একটি কোয়ান্টাম পার্টিকলের ভরবেগ যত নিখুঁত জানতে চেষ্টা করা হবে,তত তার অবস্থান সম্পর্কে ধারনা কমবে৷ যত নিখুঁত মাপতে চেষ্টা করা হবে একটি প্রপার্টি, তার কনজুগেটটি সম্পর্কে ততই কম নিখুঁত হবে মাপ৷ দুটোর গুণফল হবে একটি নির্দিষ্ট মানের বেশী, সেই মানটি প্লাংক ধ্রুবকের সঙ্গে তুলনীয়৷ আর এই মাপা বা পর্যবেক্ষণ কোয়ান্টামে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ যতক্ষণ না মাপা হচ্ছে বা কোনোরকম পর্যবক্ষণের দ্বারা বোঝা যাচ্ছে কি তার এনার্জী বা মোমেন্টাম বা পোজিশন, ততক্ষণ পর্যন্ত নাকি সেই সেই অবস্থাগুলো নির্দিষ্ট থাকে না,থাকে অনেকগুলো সম্ভাবনার সমষ্টি হয়ে যাকে কিনা এরা বলেন সুপারপোজিশন অব স্টেটস৷

এই ধারনা জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা প্রচন্ড চ্যালেঞ্জের ব্যাপার৷ আমাদের মাপার বা পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতাটাকেই একটা নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে তার উপরে একটা হার্ডকোর জ্ঞানের ক্ষেত্র তৈরী, রীতিমতো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার৷ কিন্তু মজা হলো সব পরীক্ষায় সমর্থন পাওয়া যেতে লাগলো৷ আরো আরো সূক্ষ্ম যন্ত্র আরো আরো সূক্ষ্ম পরীক্ষা, আরো আরো সমর্থন৷ না মেনে উপায়? কাজে লেগে যেতে লাগলো যে! আইনস্টাইন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই অদ্ভুত্ বিজ্ঞানকে মেনে নিতে পারেন নি৷ তিনি চিরকাল বলেছেন এ সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নয়, একটা অসম্পূর্ণ তত্ত্ব৷ এটা আরো গভীরতর সত্যের বাইরের ঢাকনা শুধু৷ কিন্তু পরীক্ষায় যদি ক্রমাগত সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে কি আর করা যাবে?

আইনস্টাইন ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্টের ব্যাখার জন্য নোবেল পান বটে,কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশী চমকে দিয়েছিলেন রিলেটিভিটি দিয়ে৷ এখন প্রায় শতখানেক বছর হয়ে গেলো তিনি আবিষ্কার করেন প্রথমে বিশেষ আপেক্ষিকতা পরে সাধারণ আপেক্ষিকতা৷ এই দুটো আমাদের জানার জগত্টাকে ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলো প্রচন্ড৷ ম্যাক্সোয়েলের ইলেকট্রিসিটি আর ম্যাগনেটিজমকে মিলিয়ে দেয়া চারটে সূত্র জানা যাবার পর থেকেই জানা ছিলো ইলেক্টোম্যাগনেটিক ওয়েভেরা সব কোনো মিডিয়া ছাড়াই ভেক্টর ফিল্ডের ওঠানামার তরঙ্গ হিসাবে স্পেসে ছড়িয়ে পড়ে৷ আর শূন্যে এদের গতিবেগ সবসময় সমান,সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার, আলোর বেগ৷ সর্বদা এই গতি৷ আইনস্টাইন তরুণ বয়স থেকে এই নিয়ে ভাবতেন৷ তিনি ভাবতেন যদি তিনি একটা গাড়ীতে চড়ে অন্য গাড়ীর পাশাপাশি চলেন তাহলে নিজের সাপেক্ষে অন্য গাড়ীটার গতি কমতে বা বাড়তে দেখেন৷ আলোর ক্ষেত্রেও কি তাই দেখবেন? উনি যদি আলোর সঙ্গে তুলনীয় প্রচন্ড গতিতে ছুটতে থাকেন, তাহলে কি হবে? নিজের সাপেক্ষে আলোর বেগ কি অনেক অনেক কম দেখবেন? এটা আবার ম্যাক্স-ওয়েলের ধারনার বিরোধী, ইএম ওয়েভের গতিবেগ একই থাকবে বলছে ম্যাক্সোয়েলের সূত্র৷

এই পাজল থেকে দুনিয়া উদ্ধার করতে বহুলোকে চেষ্টা করেছেন,তাত্বিকভাবে যারা চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে লোরেঞ্জ আর ফিটজেরাল্ড প্রথম সারির৷ লোরেঞ্জ কতগুলো সঠিক ট্রান্সফর্মেশন দিয়েছিলেন, স্পেসের তিনখানা কো-অরডিনেট আর টাইমের একখানা -এই চারটের ট্রান্সফর্মেশন দিয়েছিলেন৷ সেগুলো পরে আইনস্টাইন ব্যবহার করেন সঠিক ধারনার ফ্রেমের উপরে৷ মাইকেলসন আর মর্লির পরীক্ষাতেও প্রমান হয় আলোর গতি সর্বদা একই থাকে,আমরা তার দিকে ছুটে যেতে যেতেও তার বেগ ঐ সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইলই দেখি৷ বেশী দেখি না৷

এই পাজলকে বিশেষ আপেক্ষিকতা দিয়ে সলভ করেন আইনস্টাইন৷ তিনি উলটোদিক থেকে আসতে শুরু করেন, ঐ থিওরি শুরুই করেন দুখানা স্বত:সিদ্ধ নিয়ে, ১ হলো আলোর বেগ সবসময় সেকেন্ডে তিন লাখ কিমিই থাকবে, কোন রেফারেন্স ফ্রেম থেকে দেখা হচ্ছে তার উপরে কোনোভাবেই নির্ভর করবে না৷ ২ হলো সমস্ত ত্বরনহীন রেফারেন্স ফ্রেমে ফিজিক্সের সূত্রসমূহ একই থাকবে৷

মাত্র এই দুখানা সরলসহজ ধারনা দিয়ে শুরু হয়ে গড়ে উঠলো স্পেশাল রিলেটিভিটি৷ এই তত্বে ভর করে জানা গেলো সময়ের মাপ অন্যরকম হয়ে যাওয়া, যাকে বলে টাইম ডাইলেশন, গতির সমান্তরালে রাখা দন্ড বেঁটে হয়ে যাওয়া যাকে বলে লেংথ কন্ট্রাকশন৷ তাই থেকে সেই যমজ ধাঁধার ব্যাপার এলো, আমার ঘড়ির এক সেকেন্ড যদি আমার মহাকাশযাত্রী যমজ ভায়ের ঘড়ির আধা সেকেন্ড মাত্র হয়, তাহলে আমার যখন চল্লিশ বছর কেটেছে,ওর মাত্র কুড়ি৷ সে ফিরে এলো আমার ষাট বছর বয়সে, নিজে মাত্র চল্লিশ!!! ওদিকে আবার ব্যাপারটা আপেক্ষিক! মানে সেই ভাইও মনে করেছে আমার ঘড়ি আস্তে চলেছে ওর তুলনায়৷ জবর ধাঁধা! পরে স্পেশালের বছর দশেক বাদে জেনারেল রিলেটিভিটি দিয়ে সমাধান করা হলো এর৷সেই গলপ পরের কিস্তিতে।

অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান(৩) মহাবিশ্বের প্রসারন টসারণ নিয়ে বলতে গেলে আমাদের এই বুড়ো আইনস্টাইন আর তাঁর জেনেরাল রিলেটিভিটি লাগবেই৷ এটাই লার্জ স্কেলে মহাবিশ্ব বর্ণনার সবচেয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে ভালো থিওরি৷ যদিও এই থিওরিতে কতগুলো সিঙ্গুলারিটি আছে যেখানে তত্ত্বটি আর চলে না, তবে সেখানে কোন্ সূত্র চলবে এখনো জানা নেই৷ প্রচন্ড ঘনত্বে বা অত্যন্ত ক্ষুদ্র সাইজে কোয়ান্টাম লাগাতে হবে, সেই তত্ত্বের এখনো ক্লাসিকালধর্মী জেনেরাল রিলেটিভিটির সঙ্গে আড়ি৷ কিভাবে এদের মধ্যে মিলমিশ ঘটানো হবে তা এখনো জানা নেই, তবে খুব লড়ছেন বিজ্ঞানীরা, দিনরাত লড়ছেন৷ আপাতত এইটি মানে এই জাঁদরেল জেনেরালকে আঁকড়েই আমাদের এগোতে হবে৷ জেনারেল রিলেটিভিটি হলো স্পেশালের জেনেরালাইজড ভার্সন, অনেক সম্প্রসারিত৷ এতে সমস্ত রেফারেন্স ফ্রেমেদেরই নেয়া হলো, ত্বরিত বা ত্বরণহীন৷ সমস্ত ফ্রেমেই পদার্থবিদ্যার সূত্র সমূহ একই থাকবে এই বলা হয়েছিলো এই থিওরিতে৷

এর গাণিতিক ভিত্তি বেশ জটিল, কিন্তু ধারনাটা কথায় বলা সম্ভব৷ স্পেশাল ও জেনেরাল রিলেটিভিটি অনুসারে স্পেস আর টাইমের মধ্যে মিলমিশ ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্পেসটাইম কন্টিনিউয়াম৷ এই মহাবিশ্বে যা কিছু ইভেন্ট সবই ঘটছে স্পেসটাইম কন্টিনিউয়ামের কোনো না কোনো বিন্দুতে৷ এদের মধ্যে যে পার্থক্য তা হলো ds^2= -c^2dt^2+dr^2 পিথাগোরাসের সূত্র, কিন্তু এতে টাইম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে,সময়ের সঙ্গে আলোর বেগ c দিয়ে গুণ করে নিয়ে ইউনিটের সামাল দেয়া হয়েছে৷

তো, আইনস্টাইনএর তত্ত্ব কইলো সমস্ত বস্তু যার মাস বা ভর আছে, তা এই স্পেসটাইম কন্টিনুয়ামে তৈরী করে খোঁদল যারে এই এরা বলেন স্পেসটাইম কার্ভেচার৷ তারই ফলে আশেপাশের সরলরেখায় চলা বস্তুদের পথকে মনে হয় বক্রপথ, আসলে কিন্তু ওরা সোজাপথেই চলে৷ গ্রাভিটেশন বলে যাকে আমরা বলি তা হলো গিয়ে এই স্পেসটাইমের কার্ভেচারের ফলে বস্তুদের চলার পথ বেঁকে যায় বলে৷ অর্থাত্ এই গ্রাভিটেশন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বা স্ট্রংবা উইক ফোর্সের মতন কোনো ফোর্স নয়, এটা স্রেফ স্পেসটাইমের একটা প্রপার্টি৷

এত বৈপ্লবিক তত্ত্বকে লোকে প্রথমে নিতে চায় নি৷ কিন্তু পরে আলোর বেঁকে যাওয়া দেখে তবে মেনেছে৷ এখন তো গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং বলে একটা গবেষণার ক্ষেত্রই খুলে গেছে এই আলোর বেঁকে যাওয়া নিয়ে৷ ক্লাসিকাল নিউটনিয়ান গ্রাভিটেশনে বলা হয় গ্রাভিটেশন হলো গিয়ে ফোর্স যা কিনা ভরযুক্ত বস্তুদের উপরে প্রযোজ্য৷ এই মহাকর্ষবল এদের ভরের গুণফলের সমানুপাতী আর দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতী৷ কিন্তু আলো যার রেস্টমাস নেই, সে ফোটন বা ওয়েভ যেভাবেই দেখিনা কেন, সেটা কিছুতেই নিউটনীয় মহাকর্ষ অনুভব করবে না৷ কিন্তু আইনস্টাইনের জেনেরাল রিলেটিভিটি অনুযায়ী গ্রাভিটেশন তো বল নয়, স্পেসটাইমে তৈরী হওয়া কার্ভেচার! সেই কার্ভেচারে আলো পড়লে তার পথও যাবে বেঁকে!

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন পুর্ণ সূর্যগ্রহণের সময়ের সূর্যের কাছের তারার ছবি নিয়ে দেখিয়ে দিলেন তারার আলোর পথ গিয়েছে বেঁকে৷ তাছাড়া বুধগ্রহের অপসূর মেপেও আইনস্টাইনেরই সমর্থন পাওয়া গেলো! এখন তো গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং নিয়ে কত কাজই হচ্ছে প্রত্যেকদিন! গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং থেকেই তো সমর্থন পাওয়া গেলো না দেখা ডার্ক ম্যাটারের! দেখা গেলো আইনস্টাইন রিং৷ খুউব দূরের গ্যালাক্সিদের একাধিক ইমেজ দেখা গেলো যা আগে যায় নি!

আসলে এই গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং জিনিসটা কি? ধরা যাক কোনো খুব দূরের, দশ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের আলোক-উত্স থেকে আলো আসছে আমাদের দিকে৷ এই উত্স আর আমাদের মাঝখানে রয়েছে একটা খুব ম্যাসিভ গ্যালাক্সিপুঞ্জ! দূরের আলো এর পাশ দিয়ে আসার সময় এই ম্যাসিভ গ্যালাক্সিপুঞ্জের দ্বারা তৈরী হওয়া স্পেসটাইমের কার্ভেচারে পড়বে আর বেঁকে যাবে৷ অনেকটা লেন্সের মধ্য দিয়ে আসার সময় যেমন আলো বেঁকে যায় আর সেই যাওয়া আলোকে অনুসরণ না করতে পেরে আমরা সোজা দেখি আর একাধিক ইমেজ দেখি৷ এপ্রায় ঠিক সেইরকম ব্যাপার, তবে এক্ষেত্রে লেন্সের কাজটা করছে স্পেসটাইমের কার্ভেচার! ফোরগ্রাউন্ডের গ্যালাক্সিপুঞ্জের ডানপাশ বাঁপাশ দিয়ে বেঁকে আসা দূরের উত্সের আলো যখন আমাদের টেলিস্কোপে পড়বে তখন টেলিস্কোপ একাধিক ইমেজ দেখাবে ঐ দূরতর বস্তুর৷ এখানে ডায়াগ্রাম দিয়ে দেখাতে পারলে সুবিধে হতো আমাদের বুঝতে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এত ভালোভাবে অ্যালাইন্ড থাকে যে পুরো একটা রিং দেখা যায় দূরের উত্সের ইমেজের, ঐ ফোরগ্রাউন্ড গ্যালাক্সির চারপাশ জুড়ে৷ একে বলে আইনস্টাইন রিং।

কতটা বেঁকে গেলো আলো তা মেপে অংক কষে বার করা যায় ঐ ম্যাসিভ বস্তুটি, যে লেন্সের কাজ করলো তার ভর( mass )কত৷এই দেখতে গিয়ে লোকে তাজ্জব! দেখা গেলো ঐ গ্যালাক্সিপুঞ্জে যত গ্যালাকসি দেখা যাচ্ছে তাদের ভরটর সব যোগটোগ দিয়ে যা পাওয়া যাচ্ছে তা লেন্সিং থেকে ক্যালকুলেট করা ভরের চেয়ে অনেক অনেক কম৷ তখনি সন্দেহ হলো তাহলে কি যা দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশী ভর আছে অন্য কিছুতে? ব্রাইট অংশগুলোই সব নয়? অনেক ডার্ক ম্যাসিভ অংশ আছে যা কিনা কোনো ই এম ওয়েভ পাঠায় না? কিন্তু গ্র্যাভিটি তো লুকাতে পারবে না! ম্যাস থাকলেই স্পেসটাইমে কার্ভেচার তৈরী হবে! আগে সত্তরের দশকে গ্যালাক্সিদের রোটেশন কার্ভ থেকেও সন্দেহ হয়েছিলো যে হয়তো ডার্ক ম্যাটার আছে, এখন এই লেন্সিং থেকে ধারণাটা আরো জোরদার হলো৷